সংসদ এলাকায় একটি কক্ষে ২৪ ঘণ্টা লুকিয়ে ছিলেন পলক


ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের পর দেশ ছেড়ে চলে যান। এর পর প্রায় ২৪ ঘণ্টা জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার একটি কক্ষে আত্মগোপনে ছিলেন সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দিন মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) দুপুর পর্যন্ত পলক ওই এলাকাতেই ছিলেন। এরপর তিনি বিশেষ উপায় অবলম্বন করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরে যান। কিন্তু সেখান থেকে তাকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে যায় সেনাবাহিনী। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।


জুনায়েদ আহমেদ পলকের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, সরকারের পতনের আগের দিন স্ত্রী ও সন্তানকে বিদেশে পাঠিয়ে দেন তিনি। অবশ্য তার স্ত্রী একা যেতে চাননি। পলককে সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পালিয়ে গেলে শেখ হাসিনার সঙ্গে বেইমানি করা হবে বলে স্ত্রীকে বোঝান। পরে অবশ্য তার স্ত্রী আরিফা জেসমিন মনিকা ও তার তিন সন্তান সরকার পতনের একদিন আগেই দেশ ছাড়েন।


পলক ঘনিষ্ঠ আরেকটি সূত্রের দাবি, গত ২ আগস্ট নাটোরে নিজ এলাকায় জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে একটি বক্তব্য দেন পলক। এরপরই তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পদত্যাগের আবেদন নিয়ে যান। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাকে ধমক দেন। মন্ত্রিসভা থেকে একজন পদত্যাগ করলে অন্যরাও পদত্যাগ করবে এবং দলীয় নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙে যাবে বলে পলককে বোঝান শেখ হাসিনা।


ওই সূত্রের দাবি, জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়ার কারণে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সাবেক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও পলককে ধমক দিয়েছেন। এসব কারণে সরকার পতনের আগে তিনি দেশ ছেড়ে যেতে পারেননি বলেন জানায় ওই সূত্র।


অন্যরা কে কোথায়?


সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। পালাতে ব্যর্থ হওয়ার পর বিমানবন্দর এলাকা থেকে তাকেও সেনাবাহিনীর হেফাজতে নেওয়া হয়। তবে সদ্য বিদায়ী সরকারের অন্তত অর্ধশত মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য সুবিধাজনক সময়ে দেশ ছেড়ে গিয়েছেন। এখনও অনেকে নিরাপদ জায়গায় আত্মগোপন করে আছেন। সদ্য বিলুপ্ত হওয়া সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীও ৫ আগস্ট সংসদ এলাকাতেই অবস্থান করেন। পরে বিশেষ ব্যবস্থায় তিনি নিরাপদ জায়গায় চলে যান।


সংশ্লিষ্টরা জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগেই দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের একটি অংশ বিদেশে পাড়ি জমান। যারা বিদেশে যেতে পারেননি, তারা নিজ বাসায় না থেকে আত্মীয়-স্বজনের বাসায় আত্মগোপনে আছেন। চট্টগ্রাম-১১ আসনের চারবারের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফ নগরীর পূর্ব মাদারবাড়ী এলাকায় এক আত্মীয়ের বাসায় আত্মগোপন করেছিলেন। শুক্রবার (৯ আগস্ট) তিনি ওই আত্মীয়ের বাসা থেকে বের হয়ে স্থানীয় মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে যান। মসজিদ থেকে ফেরার পথে স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা তাকে ঘিরে ধরেন। পরে তিনি সেই আত্মীয়ের বাসায় আবারও আশ্রয় নিলে সেখানে হামলার চেষ্টা হয়। খবর পেয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাকে উদ্ধার করেন।


একটি সূত্র জানায়, সারা দেশে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী হামলা, মারধর ও হত্যার শিকার হয়েছেন। এ কারণে আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ নেতাদের অনেকেই প্রাণের ভয়ে স্বেচ্ছায় সেনাবাহিনীর কাছে ধরা দিচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় না থাকায় এসব নেতাকর্মীকে সেনাবাহিনী তাদের নিজেদের হেফাজতে রেখেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে।


পুলিশের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এখনও আত্মগোপনে


৫ আগস্টের পর সরকারের ঘনিষ্ঠ পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনেকেই আত্মগোপনে চলে গেছেন। পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহিনীর সব সদস্যকে বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) সন্ধ্যার মধ্যে নিজ নিজ কর্মস্থলে যোগদানের নির্দেশ দিলেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনেকেই যোগদান করেননি। বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সদর দফতরে নিম্ন ও মধ্যম সারির কর্মকর্তারা যোগদান করলেও যুগ্ম কমিশনার বা অতিরিক্ত কমিশনার পদমর্যাদার অনেকেই যোগদান করেননি। বিশেষ করে ডিবির আলোচিত হারুন অর রশিদসহ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ কোনও কর্মকর্তা কাজে যোগদান করেননি।


একটি সূত্র জানায়, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম, অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ, যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, পুলিশ সদর দফতরের অ্যাডিশনাল ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদারসহ কেউই নিজ নিজ কর্মস্থলে যোগদান করেননি।


পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানিয়েছে, শুক্রবার পর্যন্ত সেনাবাহিনীর সহায়তায় সারা দেশে ১১০টি মেট্রোপলিটন থানার মধ্যে ৭০টি এবং রেঞ্জের ৫২৯টি থানার মধ্যে ২৯১টি থানার কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। এছাড়া মেট্রোপলিটন  ও রেঞ্জ কার্যালয়সহ পুলিশ সুপার কার্যালয়ের প্রধানরা স্থানীয় রাজনৈতিক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে তাদের কার্যক্রম চালু করার চেষ্টা করছেন।