রাষ্ট্র কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি না, বৃহস্পতিবারের মধ্যে কাজে না ফিরলে পুলিশের চাকরি থাকবে না, চাটুকারী করলে মিডিয়া বন্ধ


অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন ব্যস্ত দিন পার করেছেন  

গতকাল। এদিন তিনি রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে অসুস্থ পুলিশ সদস্যদের দেখতে যাওয়াসহ নিজ দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। গণমাধ্যমকে পরিস্থিতি অবহিত করেছেন। গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন অনুপস্থিত পুলিশ সদস্যদের কাজে যোগ দেয়া নিয়ে। বলেছেন, বৃহস্পতিবারের মধ্যে কাজে যোগ না দিলে ধরে নেয়া হবে তিনি কাজে যোগ দিতে ইচ্ছুক নন। যেসব শিক্ষার্থী সড়ক নিরাপত্তায় কাজ করছেন তাদের সনদ দেয়া হবে বলেও জানিয়েছেন উপদেষ্টা। এ ছাড়া চাটুকারদের বিষয়েও কড়া বার্তা দিয়েছেন তিনি। ওদিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার আশ্বাসে পুলিশ কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

পুলিশের যেসব সদস্য এখনো কর্মস্থলে ফেরেননি তাদেরকে চারদিনের আল্টিমেটাম দিয়ে এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে সবাইকে কর্মস্থলে ফিরতে হবে। দেশে পুলিশ ফিরে না এলে কী অবস্থা হতে পারে তা আপনারা জানেন। একটু আগে ব্যাংকের মধ্যে মারামারি দেখলাম।


মনে হচ্ছে, যার মতো যা পারে দখল করছে। আমি প্রথমেই বলতে চাই, যারা এখনো কর্মস্থলে ফেরেননি তাদের ফেরার সর্বশেষ তারিখ হচ্ছে বৃহস্পতিবার। এর মধ্যে যোগদান না করলে আমরা ধরে নেবো, আপনারা চাকরি করতে ইচ্ছুক নন। এ বিষয়ে পুলিশের আইজিপি, র‍্যাবের ডিজি এবং ডিএমপি’র কমিশনারের সঙ্গে আলোচনা করেছি। বৃহস্পতিবারের মধ্যে যে যার স্থানে চলে যাবেন। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার থেকে আপনারা ডিউটিতে থাকবেন। কারও গায়ে অহেতুক কেউ হাত দিবেন না। বিচারের প্রক্রিয়াটা করবো আমরা। বিচার বিভাগ তাদের বিচার করবে। বড় বা ছোট যারা দোষী হবেন তাদের পানিশমেন্ট দেয়া হবে। কাউকে ঢালাওভাবে দোষারোপ করা যাবে না। 

তিনি আরও বলেন, পুলিশের আহতদের আমি এইমাত্র দেখে এসেছি। আমাদের যতদূর করা দরকার তা আমরা করবো। আপনারা বৃহস্পতিবারের মধ্যে জয়েন করেন। এটা প্রথম প্রায়োরিটি। একটু আগে দেখলাম আনসারের একটা অংশ রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে। তাদের কিন্তু দাবি-দাওয়া আছে। সবার দাবি-দাওয়া আছে। আমারও দাবি-দাওয়া আছে। আমার দাবি-দাওয়া হচ্ছে আপনারা ফিরে যান আমি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে যতটুকু করা দরকার ইমিডিয়েটলি করবো। আমি কোনো রাজনৈতিক লোক না। আমি যা বলবো তাই করবো।


চাটুকারদের রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে: সাখাওয়াত হোসেন বাংলাদেশের রাজনীতি চাটুকারদের রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করে বলেন, বাংলাদেশে আর এই রাজনীতি চলবে না। চাটুকারদের বাদ দিতে রাজনীতিবিদদের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। বলেন, আমরা কোনো রাজনীতিবিদ তৈরি করিনি। এমন চাটুকার তৈরি করেছি মানুষ মরে যাওয়ার পরও বলছে সব ঠিক আছে। এ রকম চাটুকারদের দল দিয়ে রাজনীতি করা যায় না। যেসব রাজনৈতিক দল আছে এমনকি যারা ক্ষমতায় ছিলেন, তারা আছেন, তাদের রাজনীতি চলবে। তাদের রাজনীতি বন্ধ করা যাবে না, বন্ধ হয়ও না। কিন্তু আপনারা অনুধাবন করেন, চাটুকার বাদ দেন। চাটুকারেরা এখন কোথায়, সেই প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, কত বড় চাটুকার চিন্তা করেন, একজন নেতাকে ফুল দিতে দিতে একদম কবর দিয়ে দিচ্ছে। নেতাও খুব আনন্দ পান। আর মিডিয়া না থাকলে উনি কথা বলেন না। মিডিয়া সামনে গেলে চাটুকাররা আধা ঘণ্টা কথা বলেন। এখন কোথায় গেছেন তারা? কেউ পালিয়েছেন, কেউ আত্মগোপন করেছেন। কারণ, আপনারা (নেতা) জনগণের বিপক্ষে ছিলেন, আপনারা চাটুকারিতা করেছেন। আপনারা সঠিক পরামর্শ দেননি। আপনারা হালুয়া-রুটি খেয়েছেন। একটা রাষ্ট্র এভাবে চলতে পারে না। একটা রাষ্ট্রের পলিটিকস এভাবে হয় না। একজনের ইচ্ছামতো রাষ্ট্র চালানো যায় না। মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদান ছিল ঠিকই। কিন্তু হাজার হাজার লোক যুদ্ধ করে, ত্রিশ লাখ লোক জীবন দিয়ে রাষ্ট্র স্বাধীন করেছে। এই রাষ্ট্র কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি না। আমি খুব পরিষ্কার ভাষায় বলছি, কারও পারসোনাল প্রপার্টি না। কারও পরিবারের সম্পত্তি না। তিনি বলেন, এত নষ্ট করা হয়েছে, আর কেউ এখানে ঢুকতে পারে না। ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করা হয়েছে। হাজার হাজার লোক মারা যাওয়ার পরও ক্ষমতায় থাকতে চায়। এটা দুঃখজনক, খুবই দুঃখজনক।  তিনি বলেন, যা হয়েছে, ইতিহাসকে ফেরত আনতে পারবো না। আমরা মনে করি, আওয়ামী লীগ অনেক পুরনো পার্টি, সেখানে নতুন নেতৃত্ব আসবে। তারা এ শিক্ষাটা গ্রহণ করবে। আমি চেষ্টা করবো, যাতে পলিটিক্যাল পার্টি অ্যাক্ট যাতে থাকে। সে অনুযায়ী দল চালাতে পারলে চালাবেন, নয়তো বন্ধ করে দেবেন। 


পুলিশকে লাঠিয়াল বাহিনীর মতো ব্যবহার করা হয়েছে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, পুলিশকে লাঠিয়াল বাহিনীর মতো ব্যবহার করা হয়েছে। পুলিশের হাতে মারণাস্ত্র দেয়া হয়েছে। পুলিশের হাতে ৭ পয়েন্ট ৬২ (রাইফেল) দেখে আশ্চর্য হয়েছি। এটা বোধ হয় ১৫-২০ বছর আগে দেয়া হয়েছে। পুলিশকে এই মারণাস্ত্র দেয়া ঠিক হয়নি। এটা এই জন্যই (লাঠিয়াল বাহিনীর মতো ব্যবহার) দেয়া হয়েছে। ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানোর হুকুমদাতাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া হবে। এখন আমাদের খুঁজে বের করতে হবে কারা পুলিশকে এভাবে ব্যবহার করেছে, তাদের উদ্দেশ্যটা কী? যেটা হয়েছে, আন্তর্জাতিক তদন্ত হবে, দেশি তদন্ত হবে। হুকুমদাতাদের বেশি ধরা হবে। তিনি বলেন, পুলিশ বাহিনীকে লাঠিয়ালের মতো ব্যবহার করা যাবে না। পুলিশ চলবে কমিশনের অধীনে। এই পুলিশ জনগণের পুলিশ। 


চাটুকারিতা করলে মিডিয়া বন্ধ: দেশের গণমাধ্যমও চাটুকারিতা করেছে বলে মন্তব্য করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সাখাওয়াত হোসেন। বলেন, আপনারা সত্যি ঘটনা তুলে ধরেন? আপনারা সত্যি ঘটনা তুলে ধরেননি। সত্যি ঘটনা তুলে ধরলে, পুলিশের এই অবস্থা হতো না। মিডিয়া বার বার বলেছে কিছুই হয়নি। কিন্তু বিবিসিতে আমি সব দেখেছি। টকশোতে জ্ঞানগর্ভ কোনো আলোচনা হয় না। মিডিয়া সঠিক তথ্য তুলে ধরে না। একটা দেশ তখনই ডুবে যখন মিডিয়া সত্যি কথা বলে না। মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করে। সাবেক প্রতিমন্ত্রী  লেখাপড়া জানা লোক, উনি বললেন, যা করেছে দুষ্কৃতকারীরা করেছেন। ছাত্রদের আপনি দুষ্কৃতকারী বানিয়েছেন। এসবের বিচার হওয়া উচিত। মিডিয়া মালিকদেরও বিচার হওয়া উচিত। এ সময় তিনি বলেন, চাটুকারিতা করলে মিডিয়া বন্ধ করে দেয়া হবে। আমি আপনাদের প্রমিজ করছি যদি মিডিয়া চাটুকারিতা করে তাহলে মিডিয়া বন্ধ করে দেয়া হবে। 

পুলিশের দাবি পূরণের প্রস্তুতি: পুলিশের সব দাবি পূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের পুনরায় থানায় ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমি ওনাদের ১০০ পার্সেন্ট কথা শুনবো। এমন কোনো দাবি ওনারা করেননি যে আকাশ চেয়েছেন। এগুলো করা সম্ভব। ওনারা বলছেন ৭ দিনের মধ্যে করতে, কিন্তু ৭ দিনের মধ্যে হবে না। কারণ, টাকা-পয়সার ব্যাপার আছে। আমি প্রমিজ করছি পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে, আপনারা খুব বেশি কিছু চাননি, আমরা এগুলো করতে পারবো। কিছু কিছু জায়গায় হয়তো দেরি হবে, কিন্তু কিছু জায়গায় তাৎক্ষণিকভাবে হবে। আমি এটা অবশ্যই করবো। আমার ওপর বিশ্বাস রাখুন। সেইসঙ্গে আপনারা দয়া করে থানায় ফিরে যান। 

রাস্তায় ট্রাফিকের কাজ করা শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেট দেয়া হবে: যেসব শিক্ষার্থী রাস্তায় ট্রাফিকের কাজ করছে তাদের তালিকা করে সবাইকে পুলিশের পক্ষ থেকে সার্টিফিকেট দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বারাষ্ট্র উপদেষ্টা। বলেছেন, এই সার্টিফিকেট চাকরির ক্ষেত্রে যেন মূল্যায়ন হয়। আমি আইজিপিকে অনুরোধ করবো, এই যে শিক্ষার্থী যারা রাস্তায় ট্রাফিকের কাজ করছে তাদের তালিকা করে সবাইকে পুলিশের পক্ষ থেকে সার্টিফিকেট দেবেন। এই সার্টিফিকেট চাকরি ক্ষেত্রে এটার যেন মূল্যায়ন হয়। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা নিজের টাকায় সড়কে কাজ করছে, সড়ক পরিষ্কার করছে, রঙ কিনে দেওয়াল সুন্দর করছে। এটা যদি সরকারি প্রজেক্ট হতো তাহলে হাজার কোটি টাকা লাগতো। একটা দেশে এর চাইতে ভালো উদাহরণ হতে পারে না। শিক্ষার্থীরা আমার গাড়িও ধরেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার গাড়ি থামিয়ে বলছে পতাকাওয়ালা গাড়ি। তারপর তারা বলছে পতাকা থাক আর যাই থাক গাড়ি চেক করবো। এরপর আমাকে দেখে বললো না স্যার, আপনি চলে যান। যেটা পুলিশ করতে পারতো না সেটা তারা করছে। তারা কোনো চাঁদা নেয় না। কোনো দোকানে যেয়ে বলে না খাবার দাও।

আন্দোলনে ৪২ পুলিশ সদস্য নিহত: ওদিকে উপদেষ্টাকে নিয়ে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল পরিদর্শনের পর পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম বলেন, একদিকে পুলিশের গুলিতে আন্দোলনকারী ও সাধারণ মানুষের যেমন মৃত্যু হয়েছে। তেমনি বিক্ষুব্ধ জনতার হামলায় বহু পুলিশ সদস্য হতাহত হয়েছেন। যার মধ্যে ৪২ জন পুলিশ সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। শত শত পুলিশ সদস্য নানাভাবে আহত হয়েছেন। গতকাল রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে চিকিৎসাধীন পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসার খোঁজখবর নেয়া শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। নিহত ও আহত পুলিশ সদস্যদের বিষয়ে জানতে চাইলে আইজিপি বলেন, নিহতদের মধ্যে দুজন র‌্যাব সদস্য রয়েছে। এ ছাড়া বহু আহত রয়েছেন। তাদের মধ্যে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালেই ৫০৭ জন চিকিৎসা নিয়েছে।