সরানো হচ্ছে প্রশাসনে দলবাজ শীর্ষ কর্মকর্তাদের



- ১০ সচিবের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল, বাধ্যতামূলক অবসরে জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব

- এনবিআরে নতুন চেয়ারম্যান জননিরাপত্তা ও কৃষিতে নতুন সচিব


শেখ হাসিনার ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছে গত ৫ আগস্ট। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের। চার শতাধিক মানুষ নিহত হন। আহত হন হাজার হাজার। ছাত্র-জনতার রক্তসাগরে ভেসে যায় জালিমশাহীর মসনদ। পদত্যাগে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে দেশ ছাড়েন তিনি। দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের অবসান হলেও প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়ে যায় স্বৈরতন্ত্রের ছায়া। গত ৮ আগস্ট দায়িত্ব নিয়েছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আত্মগোপনে চলে যান দলবাজ এসব কর্মকর্তা। সিনিয়র সচিব, সচিব, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতর/সংস্থার প্রধান; সব জায়গায় থাকা আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠদের সরাতে চাপ বাড়ে নতুন সরকারের ওপর।


যাদের বেশির ভাগেরই বিরুদ্ধে আবার দুর্নীতি-অনিয়মের পাহাড়সম অভিযোগ। এসব কর্মকর্তার মাধ্যমে শেখ হাসিনা তার স্বৈরতন্ত্র পাকাপোক্ত করেন। শত শত ছাত্রজনতার লাশ যখন পড়ছিল, তখনো এসব কর্মকর্তার কেউ কেউ শেখ হাসিনাকে আরো কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছিলেন। তবে ইতোমধ্যে শেখ হাসিনার কাছে সুবিধা নেয়া এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থ নিতে শুরু করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গতকাল বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মো: জাহাংগীর আলমকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠিয়েছে সরকার। একই দিন ১০ জন সিনিয়র সচিব, সচিবের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও বাতিল করা হয়।


বাধ্যতামূলক অবসরে জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব : পিটিয়ে গুলি করেও ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে পারছিল না হাসিনা সরকার। কঠোর থেকে কঠোর হয়েও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিল না এক দফার আন্দোলন। সম্প্রতি এই আন্দোলনের সময়ের একটি ভিডিও ভাইরাল হয় সামাজিক মাধ্যমে। যেখানে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি করা নিয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো: আছাদুজ্জামান খান কামালকে মোবাইলে একটি ভিডিও দেখিয়ে ডিএমপির ইকবাল নামের এক কর্মকর্তা বলছিলেন ‘গুলি করি, মরে একটা, আহত হয় একটা। একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না।



এইটা হলো স্যার সবচেয়ে বড় আতঙ্কের এবং দুশ্চিন্তার বিষয়।’ সেখানে পুলিশের সাবেক আইজিপিসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মো: জাহাংগীর আলমকেও দেখা যায়। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন বলে জানা যায়। গতকাল তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, মো: জাহাংগীর আলমের চাকরি ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় ও জনস্বার্থে তাকে সরকারি চাকরি থেকে অবসর দেয়া প্রয়োজন বিধায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সরকারি চাকরি অবসর আইন অনুযায়ী তাকে অবসরে পাঠানো হয়।

মো: জাহাংগীর আলম এর আগে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বিতর্কিত একতরফা নির্বাচনের সময় দায়িত্ব পালন করা এই কর্মকর্তাকে পুরস্কার স্বরূপ গত মে মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব পদে বদলি করা হয়।


চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল ১০ সচিবের : বিগত আওয়ামী শাসনামলে সরকারঘনিষ্ঠতা অর্জন করা শীর্ষ কর্মকর্তাদের চুক্তিতে রেখে দেন শেখ হাসিনা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মোট ৮৪ জন সচিব, সিনিয়র সচিবের মধ্যে ১৯ জনই ছিলেন চুক্তিভিত্তিক। গতকাল বুধবার এদের ১০ জনকে আলাদা আলাদা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়।



চুক্তি বাতিল হওয়া সচিবরা হলেন- এনবিআরের চেয়ারম্যান (সিনিয়র সচিব) আবু হেনা রহমাতুল মুনিম, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব কে এম আবদুস সালাম; সড়ক, পরিবহন বিভাগের সচিব এ বি এম আমিনুল্লাহ নুরী, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া ও নির্বাহী সদস্য (সচিব) মো: খাইরুল ইসলাম, পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সচিব সত্যজিৎ কর্মকার, বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোকাম্মেল হোসেন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: আলী হোসেন এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: হুমায়ুন কবীর।


এর আগে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব মো: তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। গত ৭ আগস্ট এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ গত রোববার আটটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন পদে থাকা চুক্তিভিত্তিক সব নিয়োগ বাতিলের সিদ্ধান্তও আছে। এ জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে যেসব নিয়োগ নিয়ে বেশি বিতর্ক আছে, সেগুলো অনতিবিলম্বে বাতিল করার সিদ্ধান্ত হয়। পর্যায়ক্রমে সব চুক্তি বাতিল করা হবে বলে জানা গেছে।


এনবিআরে নতুন চেয়ারম্যান, জননিরাপত্তা ও কৃষিতে নতুন সচিব : আবু হেনা রহমাতুল মুনিমের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব নিয়োগ পেয়েছেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো: আবদুর রহমান খান। আব্দুর রহমান খান বিসিএস ১৩তম ব্যাচের কর্মকর্তা। তিনি গত ১৯ মে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব হিসেবে যোগ দেন। তিনি সহকারী কমিশনার (কর), উপ-কমিশনার (কর), যুগ্ম কমিশনার (কর), কর পরিদর্শন পরিদফতরের উপ-মহাপরিচালক, বিসিএস কর একাডেমির পরিচালক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রথম সচিব পদে নিয়োজিত ছিলেন।


একইভাবে মো: জাহাংগীর আলমকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব করা হয়েছে মো: মোকাব্বির হোসেনকে। তিনি বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ওয়াহিদা আক্তারের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের পর কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব করা হয়েছে ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ানকে। তিনি পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) ছিলেন।


পর্যায়ক্রমে সরানো হবে দলবাজ অন্য কর্মকর্তাদের : বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ক্লিন ইমেজের কর্মকর্তাদের দিয়ে প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। এ অবস্থায় আওয়ামী সরকারের আমলে সুবিধাভোগী সচিব, সিনিয়র সচিবসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেয়া হবে পর্যায়ক্রমে। একইভাবে অতিরিক্ত সচিব থেকে শুরু করে নিচের পদগুলোতেও মেধাবীদের বসানোর কাজ শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।