১০ হাজার টাকার নিচে কাজই করেন না পাসপোর্ট অফিসের কর্তারা



ঘুষ এবং দালালদের বাণিজ্যালয় হিসেবে গড়ে উঠেছে বান্দরবান আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস। টাকা ছাড়া জমা দেওয়া যায় না পাসপোর্টের আবেদন। এই দুটি শব্দ যেন তাদের কাছে সাধারণ বিষয়। যদি ঘুষের টাকা কম দেওয়া হয়, তাহলে বিভিন্ন অজুহাতে আবেদনকৃত ফাইল ফেরত দেওয়া হয়। এমনকি টাকা কম দিলে অনলাইনে আবেদন করার সময় কোনো জায়গায় ভুল করে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। যারা আবেদন করে তাদের প্রত্যেকের আবেদন ফরমের পেছনের পাতায় দালালদের একটি স্বাক্ষর থাকে আর এই স্বাক্ষর দেখেই ফাইলগুলো জমা নেয়া হয় বলে জানান ভুক্তভোগীরা।


সরেজমিনে অনুসন্ধানে জানা যায়, সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকা নিচে কোনো পাসপোর্টের আবেদনে হাত দেন না বান্দরবান আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে কোনো কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। যদি কাগজপত্রে কারো সমস্যা থাকে তাহলে ঘুষ কয়েকগুণ বেশি নেয়ার অভিযোগও রয়েছে। এভাবেই খোলামেলা ভাবেই চলে আসছে তাদের এই ঘুষ-বাণিজ্য।


কক্সবাজারের টেকনাফে থেকে পাসপোর্ট করতে আসা আবদুর রশিদ বলেন, আমাদের জেলাতে পাসপোর্ট করতে অনেক দেরি হয় এবং ওখানে খুবই কড়াকড়ি। এখানে তেমন কিছু নেই, টাকা দিলে খুব সহজেই পাসপোর্ট করে দেয়। আমাদের জেলার মতো এত তথ্য যাচাই করে না।


লামা থেকে পাসপোর্ট করতে আসা একজন বলেন, আমি ১০ বছরে নতুন পাসপোর্ট করেছি। আমার কাছ থেকে ১২ হাজার টাকা নিয়েছে বান্দরবান পাসপোর্ট অফিস।


বান্দরবান সদরের বাসিন্দা ফাহিম বলেন, আমি আমার দাদুর পাসপোর্ট করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু যেখানে সরকারিভাবে নেয়ার কথা ৫ হাজার ৭৫০ টাকা। সেখানে আমার কাছ থেকে চেয়েছে ১০ হাজার টাকা। আমি প্রতিবাদ করলে উল্টো আরো হুমকিমূলক কথাবার্তা বলেন তারা।


রোয়াংছড়ি উপজেলার বাসিন্দার ইউছুফ বলেন, আমি বাইরে থেকে পাসপোর্টের আবেদন পূরণ করে পাসপোর্ট অফিস জমা দেই। পরে আমাকে বলে এটা হবে না, বাইরে থেকে পূরণ করলে জমা নেয়া হয় না। পরে আমাকে অফিসের এক কর্মচারীকে দেখিয়ে বলেন, ওনার সঙ্গে কথা বলেন। ওনার কাছে গেলে উনি সব কাগজ দেখে বলেন, ৩ হাজার টাকা দেন সবকিছু আমি ঠিক করে জমা দিয়ে দেবো। আমি কোনো উপায় না পেয়ে তাকে ৩ হাজার টাকা দিতে বাধ্য হলাম।


আরেক ভুক্তভোগী বলেন, আমি বাইরে থেকে আবেদন ফরম পূরণ করে অফিসে জমা দিতে যাই। এ সময় আমাকে তারা বলেন, এটা হবে না আপনি স্যারের কাছে যান। এরপর এক স্যারের কাছে গেলে উনি সব কাগজ দেখে আমাকে বলেন, এখানে ঝামেলা আছে আপনি এডি’র সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে ওনার অপেক্ষায় বসে থাকি। এর মধ্যে একজন আমাকে এসে বলেন, আপনার কি সমস্যা হয়েছে আমাকে দেন আমি স্যারকে দিয়ে সব কাজ করে নেবো। এর বিনিময়ে ৫ হাজার টাকা দিতে হবে।


রামু থেকে মোরশেদ আলম নামের একজন তার ছেলেকে বিদেশে পাঠানোর জন্য পাসপোর্ট করতে আসেন। তিনি বলেন, ‘পাসপোর্ট ৫ বছরের হোক বা ১০ বছরের হোক। অফিসে সরকারি ফি এর বাইরে নাকি ৫ হাজার টাকা বেশি দিতে হবে।’

নাইক্ষংছড়ি উপজেলার বাইশারি থেকে এসেছিলেন জাহেদুল করিম ও মোহাম্মদ নুর। তারা জানান, তাদের কাছ থেকে সরকারি ফি ছাড়াও ৩ হাজার টাকা করে বেশি নেয়া হয়েছে।

তাছাড়াও দালালদের বিচরণও দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে বান্দরবান পাসপোর্ট অফিসে। ভুক্তভোগীদের বিভিন্ন অভিযোগের সূত্র ধরে পাসপোর্টের আবেদনকারী সেজে কথা হয় বান্দরবান পাসপোর্ট অফিসের বাহাদুর ম্রো নামক এক দালালের সঙ্গে। বিভিন্ন কাগজপত্র নিয়ে কথাবার্তা শেষে তার কাছে পাসপোর্টের আবেদনের করতে কত টাকা লাগবে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি মুখের ওপরে বলে দেন ১২ হাজার টাকা লাগবে। তার মধ্যে অফিস ম্যানেজ হয়ে যাবে এবং পুলিশ ভ্যারিফিকেশন আবেদনকারীকেই করতে হবে বলেও জানান এই দালাল। যদি কাগজপত্রের কোনো দিকে ত্রুটি থাকে তাহলে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকাও হতে পারে বলে জানান দালাল সুমন। একজন-দুইজন নয় প্রায় ডজনখানেক দালাল এভাবে প্রতিদিন তৎপরতা চালান বান্দরবান আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে।


বান্দরবান পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক আলীম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, আমি মাত্র কয়েকদিন হলো বান্দরবানে যোগদান করেছি। আমি আসার পর থেকে এ রকম কোনো লেনদেন হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। অবৈধ কোনো লেনদেনের সুযোগ নেই। এই অফিসে দালালদের কোনো স্থান নেই। হয়তো আমি আসার আগে এ রকম অনিয়ম হয়েছে। কিন্তু এখন আর সেই সুযোগ পাবে না। যদি এ রকম হয়ে থাকে তাহলে আমি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।