অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। গতকাল বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত এসব বৈঠক হয়। বৈঠকে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করেন দলগুলোর নেতারা। তারা সরকারকে বিভিন্ন পরামর্শও দেন। এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে সরকার পরিচালনা ও শৃঙ্খলা ফেরাতে দলগুলোর সার্বিক সহায়তা চান। বৈঠকে ১৫ই আগস্ট শোক দিবস নিয়ে কয়েকটি দলের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন বাহিনীকে সচল করার তাগিদ দেয়া হয়। কোনো হত্যাকারীর পুনর্বাসনের দায়িত্ব যাতে এই সরকার না নেয় সে বিষয়ে তাগিদ দেয়া হয়। পরবর্তী নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় সংস্কারের তাগিদ দিয়ে দলগুলো বলেছে- এজন্য যৌক্তিক সময় দিতে তারা রাজি। এ ছাড়া উপদেষ্টাদের অতিকথন থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
সামনের কয়েকদিন রাজনৈতিক দলগুলো মাঠে সতর্ক অবস্থানে থাকবে বলে প্রধান উপদেষ্টাকে জানানো হয়। তারা জনতার মঞ্চ তৈরি করে অবস্থান নেয়ার কথাও জানিয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বরে দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার ধারাবাহিক বৈঠক হতে পারে বলে নেতারা জানিয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, আদিলুর রহমান খান, মো. নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং ফরিদা আখতার। গতকাল বিকাল ৪টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি। বিএনপি’র প্রতিনিধিদলটি বিকাল ৪টা ৫০ মিনিটে বের হয়। বিএনপি’র প্রতিনিধিদল যমুনায় থাকতেই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল যমুনায় প্রবেশ করে। বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা হয়নি। তবে নির্বাচনের যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তারা সরকারকে সময় দিয়েছেন। ঠিক একই কথা জানিয়েছে জামায়াতও। তারাও নির্বাচনের বিষয়ে এই সরকারকে সময় দিতে চান। দলটির আমীর শফিকুর রহমান বলেন, নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা হয়নি। উনারা কেবল দায়িত্ব নিলেন। মাত্র চারদিন হলো। আমরা দেখতে চাই, কীভাবে উনারা জাতিকে নিয়ে এগোতে চাচ্ছেন। সমস্যাগুলো সমাধান কীভাবে করেন। জামায়াতের সঙ্গে বৈঠকের পর এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদের দুই অংশের সঙ্গেও যৌথ বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। এরপরে গণতন্ত্র মঞ্চ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ এবং ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (এনডিএম)-এর সঙ্গে বৈঠক করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বৈঠকে শেষে এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, নির্বাচন নিয়ে আমরা কোনো কথা বলিনি। আমরা আগেও বলেছি, নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে নির্দিষ্ট একটা সময় লাগবে। আমরা তাদেরকে সেই সময়টা অবশ্যই দিয়েছি। আর আমরা তাদের সব বিষয়ে সমর্থন দিয়েছি।
তিনি বলেন, এই সরকারকে সহায়তা করা প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষের একমাত্র কর্তব্য। আজকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই মহলটি, যারা বাংলাদেশের মানুষের অধিকারকে হরণ করে নিয়েছিল-তারা পালিয়ে গিয়ে ভারতে অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের বিজয়কে নস্যাৎ করার চক্রান্ত শুরু করেছেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, এত হত্যা, নির্যাতন, নিপীড়নের পর সেই দলটি আবারো বিভিন্ন রকম কথা বলছে। যা বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে। আমরা মনে করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার অবশ্যই সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলবেন। কিন্তু কোনো হত্যাকারীর সঙ্গে না। যারা ছাত্র, শিশু, রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে জনগণ আছে। এ ব্যাপারে সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে। তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছি। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কী কী করা যায়, সে বিষয়ে মতামত দিয়েছি। তারাও কী কী করতে যাচ্ছেন তা আমাদের সঙ্গে শেয়ার করেছেন।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন- বিএনপি’র স্থায়ী কমিটি সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ ও বেগম সেলিমা রহমান।
বিকাল ৫টায় যমুনায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে বৈঠকে বসেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর একটি প্রতিনিধিদল। তারা ৫টা ২৫ মিনিটে যমুনা থেকে বের হন। এ সময় যমুনার সামনে উপস্থিত সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে শফিকুর রহমান বলেন, কেউ আমাদের নিষিদ্ধ করে দিলেই কি আমরা নিষিদ্ধ হয়ে গেলাম? এটা আমরা মনে করি না। কারণ শেষের দিকে সরকার এমন অনেক ভুল কাজ করেছে। যেটার মাসুল দেশবাসীকে দিতে হবে। সরকারকে তো দিতেই হবে। আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন আন্দোলনকে ভিন্নখাতে নেয়ার জন্য জামায়াতকে হঠাৎ করে নিষিদ্ধ করে দেয়া হলো। জাতি এই মতলব বুঝে। তারা এটা গ্রহণ করে নাই।
রাষ্ট্র পরিচালনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে জামায়াত সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে বলেও জানান তিনি। জামায়াতের আমীর বলেন, বিভিন্ন দিক থেকে অনেকে ষড়যন্ত্রের কথা বলছেন, আমাদের এখানে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ যারা আছেন- কিছু জায়গায় তাদের ওপর হামলা হয়েছে। কিন্তু হামলাটা ধর্মীয় কারণে হয়েছে না কি রাজনৈতিক কারণে হয়েছে, এটা খুঁজে বের করতে হবে। তিনি জানান, দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আমাদের করণীয় কি, এ বিষয়ে আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো। সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
জামায়াতের আমীরের নেতৃত্বে বৈঠকে অন্যদের মধ্যে দলটির নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের, মাওলানা আ.ন.ম শামসুল ইসলাম, সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, হামিদুর রহমান আযাদ, এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন, প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমীর নূরুল ইসলাম বুলবুল, উত্তরের আমীর মো. সেলিম উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক এডভোকেট হাসনাত কাউয়ুম, জেএসডি’র সিনিয়র সহ-সভাপতি তানিয়া রব ও সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন অংশ নেন।
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম মেম্বার ওয়াসিকুর রহমান অঞ্জন এবং মহাসচিব আব্দুল মতিন সাউদ প্রতিনিধিদলে ছিলেন।
এবি পার্টির পক্ষে বৈঠকে আহ্বায়ক এ এফ এম সোলায়মান চৌধুরী ও সদস্য সচিব মুজিবুর রহমান মঞ্জু প্রমুখ অংশ নেন।
গণঅধিকার পরিষদের একাংশের সভাপতি নুরুল হক নুর ও সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান এবং অপর অংশের আহ্বায়ক কর্নেল (অব.) মিয়া মশিউজ্জামান ও সদস্য সচিব ফারুক হাসান অংশ নেন।
২৫ মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক-
দ্রুত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের নির্দেশ
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তার অধীন ২৫ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব ও সচিবরা। বৈঠকে সরকারের নেয়া সিদ্ধান্ত সমূহ দ্রুত বাস্তবায়ন করতে সচিবদের নির্দেশ দেন তিনি। বৈঠক শেষে গতকাল সচিবালয়ে ব্রিফ করেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী। সকাল সোয়া ১১টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় এই বৈঠক হয়।
জনপ্রশাসন সচিব জানান, সব মন্ত্রণালয়ের কাজ দ্রুত চালু করার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এজন্য সাতদিন সময় দিয়ে এখন থেকে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন। সচিব বলেন, গত কয়েক বছর যারা পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের দাবিগুলো শুনে শিগগিরই সিদ্ধান্ত হবে। মন্ত্রণালয় এবং দপ্তরগুলোকে দ্রুত ফাংশনাল করার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। পিএসসি ২৮ থেকে ৪২ বিসিএস’র সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছিলেন তাদের বিষয়গুলো আমি উপস্থাপন করেছি। আশা করি কাল-পরশুর মধ্যে একটা ধারণা দিতে পারবো। কী কী কারণে পদোন্নতি হয়নি সে বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করবো।