দেশের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। আজ মঙ্গলবার তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিযুক্ত হয়েছেন। ড. মনসুর ১৯৮১ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে যোগদান করেন। তিনি ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ফিসকাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগে কাজ করেছেন। ১৯৮৯ সালে অর্থমন্ত্রী ওয়াহিদুল হকের অর্থ উপদেষ্টা নিযুক্ত হন এবং ১৯৯১ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়া বিভাগে দায়িত্ব পালন করেন ড. মনসুর।
সম্প্রতি ডেইলি বাংলাদেশের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে নানা বিষয়ে কথা বলেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই অর্থনীতিবিদ।
বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের মূল চ্যালেঞ্জ কী?
ড. আহসান এইচ মনসুর: দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থা কাটিয়ে ওঠাই নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল চ্যালেঞ্জ। এজন্য তাদেরকে শতভাগ কাজ করতে হবে।
দেশের অর্থনীতি এখন কোন দিকে যাবে?
ড. আহসান এইচ মনসুর: বাংলাদেশের অর্থনীতির সমস্যা এখন অনেক। একটি বড় সমস্যা হলো সামগ্রিক অর্থনীতির ভারসাম্যহীনতা। মূল্যস্ফীতির চাপ, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, রিজার্ভ কমে যাচ্ছে, রফতানি ও রেমিট্যান্স বাড়ছে না। সব মিলিয়ে সামগ্রিক পরিস্থিতিতে অর্থনীতি ভালো নেই। এর সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের অর্থনীতির দুটি সমস্যা বিরাজ করে আসছে। প্রথমটি হলো- আর্থিক খাতে সমস্যা বিশেষত ব্যাংক খাত, শেয়ারবাজার ও বীমা খাত সবই ভঙ্গুর অবস্থা। দ্বিতীয়ত, রাজস্ব খাতের ব্যবস্থাপনায় সমস্যা।
এ সমস্যাগুলোর মূল কারণ হলো রাজনৈতিক। অপরাধীকে প্রশ্রয় দেওয়া এবং অনেক ক্ষেত্রে সহযোগী হিসেবে কাজ করা। এত বড় ব্যাংকগুলোতে এত লুট হয়েছে- এটা কোনোভাবেই একক বা ২-৪ জনের পক্ষে সম্ভব নয়। এখানে ধরেই নিতে হবে সর্বোচ্চ পর্যায়ে সহযোগিতা না পেলে এরকম হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে পার করে ফেলা যায় না। কারণ, বাংলাদেশের অর্থনীতি খুবই ছোট। রাজনৈতিক ছত্রছায়াতেই লুটপাট হয়েছে।
দেশের অর্থনীতির মূল ধারা ফেরাতে এখন কী করণীয়?
ড. আহসান এইচ মনসুর: আমাদের অন্তর্বর্তী সরকারকে কিছু বিষয়ে দ্রুত কাজ করতে হবে। প্রথমত, দেশের রাজনৈতিক ধারা পুনর্গঠন করতে হবে। পরিবারতান্ত্রিক যে রাজনীতি চলে আসছে, তা চলতে দেওয়া যাবে না। প্রতিটি দলের মধ্যে নেতা তৈরি হতে পারে। এজন্য রাজনৈতিক গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন আনতে হবে।
দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশের সরকার-বেসরকারি সকল অফিসে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সরকারকে কিছু জায়গায় দ্রুত পরিবর্তন আনতে হবে। পাসপোর্ট অফিস, ভূমি অফিস, লাইসেন্সের অফিসগুলোতে পরিবর্তন আনতে হবে। সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। জনগণ এটা দেখবে না যে, ৩-৪ বছর একটা অনির্বাচিত সরকার থাকবে, কিন্তু কোনো ফল দেবে না। রাজনৈতিক দলগুলো চাইবে দ্রুত ভোট হোক, আমরা ক্ষমতায় যাই, আবার লুটপাট করি। এগুলো ঠেকাতে হলে দ্রুত কিছু ভালো ফলাফল জনগণকে দিতে হবে। জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে।
তৃতীয়ত, শিক্ষা খাতকে সংস্কার করতে হবে। শিক্ষার মান, শিক্ষকের মান বাড়ানোর জন্য সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে হবে। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দিতে হবে। অন্যতম খাত অর্থনীতি সস্কারের জন্য কমিশন গঠন করতে হবে। ব্যাংককেন্দ্রিক অভিজ্ঞ লোক দিয়ে কমিটি গঠন করতে হবে। দ্রুত ৬০টি ব্যাংকে রিভিউ করতে হবে। সরকারকে চেষ্টা করতে হবে ব্যাংক সংখ্যা কমিয়ে ১৫-২০টিতে আনতে হবে। এত ব্যাংকের আমাদের দরকার নেই। যেসব ব্যাংকের মালিক দেশ ছেড়েছেন তারা যেন আর দেশে আসতে না পারেন। তাদের ব্যাংকের মালিকানাও দরকার নেই। এগুলোকে একীভূত করে ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে।
শেয়ারবাজারের জন্য আলাদা কমিটি গঠন করতে হবে। এরা নন ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান, ইন্সুরেন্স, শেয়ারবাজার দেখবে। দেশের রাজস্ব খাতে সংস্কার করতে হবে। এ খাতের বড় সংস্কারের জন্য তিনটি কমিটি গঠন করতে হবে। ভ্যাট, ডিরেক্টর ট্যাক্স, ট্রেড ট্যাক্সে এর ভিন্ন কমিটি গঠন করতে হবে। ছয় মাসের মধ্যে রোড ম্যাপ তৈরি করতে হবে। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত ট্যাক্স জিডিপি ভারতের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া। ভারতের কাছাকাছি ১৮ শতাংশে নিয়ে যেতে পারলে আমাদের কোনো সমস্যা থাকবে না।
রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বাড়ানোর উপায় কী?
ড. আহসান এইচ মনসুর: এগুলো এমনিতেই বেড়ে যাবে যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠা হয়। আমাদের রেমিট্যান্স কমার প্রধান কারণ অর্থ পাচার। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ঘুষ, দুর্নীতি বন্ধ হবে। তাহলে অর্থ পাচার বন্ধ হয়ে যাবে। কেউতো বৈধ টাকা পাচার করবে না।
রিজার্ভ কি বাড়বে?
ড. আহসান এইচ মনসুর: দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে পারলে রিজার্ভ বেড়ে যাবে। সুদ হারকে বাজারভিত্তিক করা হয়েছে, ঐভাবেই রাখতে হবে। সঙ্গে বাজেটের আকার কমিয়ে আনতে হবে। সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি কমে গেলে রিজার্ভ বেড়ে যাবে। অর্থ পাচারের কারণে দেশের রিজার্ভ কমে গেছে।