একটা গল্প। ২০১১ সালের। এক গরিব বিজ্ঞানীর সব হারানোর গল্প। বিজ্ঞানীর নাম মুহম্মদ ইউনূস। নামের আগে ডক্টর আছে। ৪৮ বছর আগে এই বিজ্ঞানী এক স্বপ্ন দেখেন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের পর। ১৯৭৬ সালে এই স্বপ্ন দেখেন তিনি। গরীব মানুষ সব নাই করে দেবেন। খুন, গুম করে না, এক নতুন ফর্মুলায়। গরিবদের টাকা ধার দিয়ে আত্মনির্ভরশীল করবেন। কোনো কাগজপত্র জমা দিতে হবেনা। টাকা ধার নাও, কাজ করে শোধ দাও।
কিন্তু টাকা ধার দিবেন কী করে ? বিজ্ঞানী নিজেই তো গরিব। গেলেন ব্যাংকারদের কাছে।
গরিবের জন্য লোন শুনে ব্যাংক ম্যানেজাররা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো। দুঃখ পেলেন বিজ্ঞানী। বাসায় এসে গুনে দেখেন আছে ২৭ ডলার । এটা দিয়েই শুরু করলেন জেদি তিনি। টাকার হিসেবে ২৭ ডলার ।
চট্টগ্রামের ছোট্ট গ্রাম জোবরা। এই গ্রামের কিছু গরিব নারীদের হাঁস-মুরগী পালনের জন্য টাকা ধার দিলেন । আর কি ম্যাজিক! সময়মতো সব মহিলা ধারের টাকা ফেরত দিতে লাগলো। ছোটো ছোটো খামার করে তারা লাভ করছে । স্বাবলম্বী হচ্ছে। ছড়িয়ে পড়তে লাগলো এই ডালপালা। গরিব সব একে একে নাই হতে লাগলো। আজ সারাবিশ্ব যে 'গ্রামীণ ব্যাংক' চেনে, এটা সেই জোবরা গ্রামে ২৭ ডলারের বপন করা বীজের বটবৃক্ষ। ডালপালা ছড়িয়ে তা ছায়া দিচ্ছে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকায় ।
আমি আবেগপ্রবণ মানুষ। ছোটোকালে ফুটবল খেলায় মোহামেডান জিতলে খুশিতে কাঁদতাম, হারলে দুঃখে । দেশের ভালো কিছু দেখলে খুশিতে আরো বেশি কাঁদি। ২০০৬ সালে যখন হঠাৎ সেই বিজ্ঞানী ও তাঁর গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পেলো, আকাশের দিকে চেয়ে পাথর হয়ে গেলাম।
মুশকিল হয়েছিলো বিজ্ঞানীর পুরষ্কার নেয়ার দিন। নরওয়ের বিশাল রাজকীয় হলরুমে তিনি ঢুকলেন সাধারণ পোশাকে। দেখে মনে হচ্ছে একজন দরিদ্র প্রাইভেট টিউটর। সাথে শাড়িতে মাথায় কাপড় টানা এক সাধারণ নারী। গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালক। যেন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। বেজে উঠলো রাজকীয় বিউগল। বাংলাদেশের এক প্রাইভেট টিউটর আর প্রাইমারি শিক্ষিকাকে ঢুকতে দেখে আমেরিকা- ইউরোপের বাঘা বাঘা রাজা - রাষ্ট্রপ্রধানরা গেলেন দাঁড়িয়ে। আর তা দেখে আমি দিলাম ঝরঝর করে কেঁদে। এর পরের বছর আমার একটা বই বের হলো- ফেড জিন্স আর বাদামি কোট। বইটা ইউনূস স্যারকে উৎসর্গ করলাম। উনার সাথে তখনও আমার দেখা হয়নি ।
২০১১ সালে আমাদের গল্পের বিজ্ঞানী হারালেন সব। তাঁর সারাজীবনে গড়া গ্রামীণ ব্যাংক ছিনিয়ে নিয়ে নেয়া হলো তাঁর কাছ থেকে। আমার হাত রাগে আস্তে আস্তে মুষ্টিবদ্ধ হতে লাগলো। এটাও আমার চরিত্র। যখন রাগ হই, নৃশংসতম দানব দানবীর সামনে দাঁড়াতে বিন্দুমাত্র ভয় পাই না।ইউনূস স্যারের জন্মদিন ২৮ জুনকে ঘিরে প্রতিবছর ৩দিন ধরে একটা উৎসব হয়- সোশ্যাল বিজনেস ডে। দেশি-বিদেশি অতিথিরা আসেন। এবারের ২০১১ সালের প্রোগ্রামটা স্পেশ্যাল। স্বৈরাচারের রোষানলে পড়ে সবহারা বিজ্ঞানীর অনুষ্ঠানের আয়োজকরা হোটেল সোনারগাঁও- এর বলরুমে অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে ।
গিয়ে উপস্থিত হলাম সেই অনুষ্ঠানে। বিজ্ঞানীকে নিয়ে সেই সময়টায় পরিস্থিতি থমথমে। দেশের বাঘা বাঘা সবাই ভয়ে এই প্রোগ্রাম এড়িয়ে চলছেন। চ্যানেল আই-এর ফরিদুর রেজা সাগর ভাই নিজে না এসে কর্মচারি দিয়ে কেক পাঠিয়েছেন। আমাদের জেনারেশনের মিডিয়ার কাউকে দেখলাম না। সরাসরি ইউনূস স্যারের কাছে গিয়ে সালাম দিলাম, পরিচয় দিলাম। স্যার বললেন- বসো। স্যারকে চাঙা করতে শক্ত হাতে হাত ধরে বললাম- 'ভয় পাবেন না স্যার, আমি পাশে আছি।' হো হো করে হেসে দিলেন বিজ্ঞানী। তাঁর দৃষ্টি ঈগলের চেয়ে শার্প। সন্দেহ করার বদলে আমাকে পছন্দ করলেন। আলাপ করলাম কিছুক্ষণ। আমাকে তাঁর ব্যক্তিগত ভিজিটিং কার্ড দিলেন। অফিসে আসতে বললেন। আসার আগে ফোন দিতে বললেন।
আমরা সারাদিন কাটালাম। খাওয়া-দাওয়া করলাম। দুপুরের দিকে ড. আসিফ নজরুল ভাইকে দেখি হনহন করে এসে বাইরে থেকে উঁকি দিচ্ছেন। বললাম- আরে আসিফ ভাই, কাকে খুঁজছেন? আসিফ ভাই মনে হলো চমকে বিব্রত হলেন। বললেন- 'না ইয়ে শায়ের কেমন আছেন, অমুক (সম্ভবত একজন সাংবাদিকের নাম বলেছিলেন) কি এখানে আছে?' বলেই উত্তরের আশা না করে দ্রুত পুলসাইডের দিকে চলে গেলেন। সেই অনুষ্ঠানে আসিফ ভাই সশরীরে ছিলেন না। তবে পরের বছর তিনি ইউনূস স্যারের সাথে ইউরোপে (সম্ভবত জার্মানি) সফরসঙ্গী হয়েছিলেন অন্য আরেক অনুষ্ঠানে। সেখানে স্পেনের রানী এসেছিলেন। বিষণ্ণ ইউনূস স্যারকে চাঙা করতে রাণী ড্রাম বাজিয়েছিলেন, সাথে স্যারও। ইউনূস স্যারের ড্রামে আঘাত করার বডি ল্যাঙ্গুয়েজে মনে হচ্ছিলো ড্রাম না, সম্ভবত কাউকে পেটাচ্ছেন।
আমাদের অনুষ্ঠানের দিন দুয়েক পর সাহস করে ইউনূস স্যারের ওপর একটা চমৎকার ব্যঙ্গ রচনা লিখি দৈনিক মানবজমিনে। এই লেখাটি বিশেষ কারণে উজ্জ্বল। সে সময়ে আর কোনো লেখক সাহস করেনি স্বৈরাচারের রোষানলে পড়া এই বিজ্ঞানীকে নিয়ে কিছু লিখতে। সেটাই ছিলো স্যারের দুঃসহ সেই দিনে তাঁকে নিয়ে প্রথম আর্টিকেল আর তা ছাপিয়ে দেন মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী ওরফে আমাদের প্রিয় মতি ভাই। লেখাটা এতোই সাড়া ফেলেছিলো যে, নিউইয়র্ক থেকে আমেরিকান লেডি, ফ্রান্স থেকে ফরাসী যুবক, ডেনমার্ক- নরওয়ে- সিঙ্গাপুর- সুইডেনসহ অনেক দেশ থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা আমাকে বাহবা দিয়ে ই-মেইল পাঠাচ্ছিলেন। লেখাটা এখনো আমার সংগ্রহে আছে। সেই দুর্যোগপূর্ণ বছরগুলোয় (২০১১-২০১৩) আমি মাঝে মাঝেই ইউনূস সেন্টারে যেতাম। সেখানের কিছু চমৎকার অফিসিয়ালদের সাথে আড্ডা দিতে। এটাও আমার অভ্যাস। পছন্দের জায়গার মানুষদের সাথে আমি আড্ডা দিতে পছন্দ করি বিশেষ করে যখন তারা মানসিক চাপে থাকে। এরপর অবশ্য কিছু কারণে আর যাওয়া হয়নি।
মজার কথা দিয়ে শেষ করি। ইউনূস স্যারের সাথে আমার এরপর একাধিকবার দেখা হলেও উনাকে যে আমার বই উৎসর্গ করেছিলাম, সেটা মনেই ছিলোনা। তাঁকে এক কপি দেয়াও হয়নি। বই উৎসর্গের বিষয়ে আসিফ নজরুল ভাইয়ের সাথে আমার এক আজব অতীন্দ্রিয় যোগাযোগ আছে। আমি দু'জন বিখ্যাত মানুষকে বই উৎসর্গ করেছি। লেখক হুমায়ূন আহমেদকে আর ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসকে। হুমায়ূন স্যারকে উৎসর্গ করা বই দিতে যখন বইমেলার স্টলে যাই, আসিফ নজরুল ভাইকে ক্রস করেছিলাম। তিনি পেয়েছেন হুমায়ূন স্যারের মেয়েকে। আর ইউনূস স্যারকে ২০১১-তে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে সোনারগাঁও বলরুমে আসিফ ভাইকে উঁকি দিতে দেখতে পাই। তিনি পরের বছর পান স্পেনের রাণীকে। উনার উচিৎ এই অতীন্দ্রিয় কেমিস্ট্রির সুফল নিতে মাঝে মাঝে হাতে কোনো পাথর নিয়ে এসে আমার সাথে দেখা করা। আমি পাথরটা ছুঁলেই সেটা উনার জন্য সোনা হয়ে যাবে।
প্রিয় ইউনূস স্যার। আপনার আমার কাছে একটা পাওনা আর একটা দেনা আছে। পাওনাটা হলো ১৭ বছর আগে আপনাকে উৎসর্গ করা আমার বইটা। সেটা আপনাকে দিয়ে আমি দায়মুক্ত হতে চাই। আর আপনার দেনাটা হলো , আপনি ছিনতাই হওয়া গ্রামীণ ব্যাংক আবার আপনার কাছে ফিরিয়ে এনে আমাকে খুশিতে হাসিয়ে দেবেন। এবার হাসবো, কাঁদবো না । আপনি দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ায় আমি যারপরনাই খুশি হয়েছি। দেশে নানা ঘটনা ঘটছে । চোখ কান খোলা রাখবেন। নেইল আর্মস্ট্রং চাঁদ জয় করতে পেরেছিলেন নাসার সদা জাগ্রত সুতীক্ষ্ণ ও দক্ষ বিজ্ঞানীদের সহায়তায়।
আপনাকে অভিনন্দন ও সালাম। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।