গত জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়কারীকে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে হেফাজতে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর– শেষবারের মতো আলোচনায় আসেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ। পরে সমন্বয়কদের সাথে এক টেবিলে বসে খাবার ছবি এবং তাদের দিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের বিবৃতি দেওয়ার ভিডিও প্রকাশ করেন তিনি।
তার এই কর্মকাণ্ডকে জাতির সাথে মশকরা বলেও মন্তব্য করেন উচ্চ আদালত। হাইকোর্টের এমন মন্তব্যের পরও ওই ছয় সমন্বয়কারীকে বেআইনিভাবে আটকে রাখা হয় প্রায় এক সপ্তাহ। এর মাঝে তার একটি আপত্তিকর ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
পরে ১ আগস্ট তাকে গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) দায়িত্ব থেকে সরিয়ে ডিএমপির ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস শাখায় পদায়ন করা হয়। নতুন অফিসে সবশেষ ২ আগস্ট দায়িত্ব পালন করেছিলেন হারুন। এরপর থেকেই তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না।
২০১১ সালের জুলাইয়ে জাতীয় সংসদের সামনে এক মিছিলে তৎকালীন বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ জয়নাল আবেদীন ফারুককে মারধর করে প্রথম আলোচনায় আসা হারুন এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। গোয়েন্দা পুলিশের মানুষকে তুলে নিয়ে গিয়ে ভাত খাইয়ে ভিডিও ছেড়ে দেয়া, বিরোধী দলের প্রতিটি আন্দোলনে বিএনপির প্রধান কার্যালয়ে ‘বোমা ও বাঁশের লাঠিসোটা’ উদ্ধার, প্রতিদিনই সাংবাদিকদের একাধিকবার ব্রিফিং করা, তারকাদের সাথে ফটোসেশন, যাকে তাকে ডিবিতে তুলে নিয়ে আসা, হেফাজতে নির্যাতন, আপত্তিকর ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়–এমন নানান নেতিবাচক কাজে দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচিত এই কর্মকর্তা। একটি সূত্র দাবি করছে, সমালোচিত এই পুলিশ কর্মকর্তা এখন রাজধানীর একটি বিশেষায়িত হাসপাতালে গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর থেকে পলাতক আছেন পুলিশের অন্তত ৫৭ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এর মধ্যে আছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়ন্দা বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার ও বহুল আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশীদও।
পুলিশের এসব কর্মকর্তাদের মধ্যে তাকে নিয়েই জনমনে এখন প্রবল জিজ্ঞাসা, কোথায় আছেন এই ডিবির হারুন। তার পরিবারের সদস্য, পুলিশের সহকর্মী ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা যাচ্ছে, তিনি নিজের বাসা এমনকি আত্মীয়স্বজন কারো বাসাতেই থাকছেন না। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন। তবে আরেকটি সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে, ডিবির এই কর্মকর্তা ৬ আগস্ট গণপিটুনির শিকার হয়ে রাজধানীর একটি বিশেষায়িত হাসপাতানে চিকিৎসাধীন। তার একজন আত্মীয় টিবিএসকে বলেছেন, তিনি এতোটাই ‘জনপ্রিয়’ হয়ে গেলেন যে এখন প্রকাশ্যে আসতেও ভয় পাচ্ছেন।
কেমন ছিল ৫ আগস্টের শেষ কয়েক ঘণ্টা?
৫ আগস্ট সোমবার ছাত্র-জনতার ঢাকা অভিমুখে লংমার্চের ঘোষণার দিন পুলিশ অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করবে– এমনটাই আগের দিন জানিয়েছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান। আগের দিন রোববার রাতে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আর এক বিন্দু ছাড়ও দেয়া হবে না। পুলিশ হত্যাকারীদের কোন ছাড় দেয়া হবে না।’ এমন ঘোষণার পর সোমবার সকাল থেকে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয় ঢাকার সব প্রবেশমুখে।
ডিবির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদসহ সব ঊর্ধ্বতন কর্মকতারা সেদিন সকালেই চলে যান রাজধানীর সচিবালয়ের বিপরীতের আবদুল গণি রোডের সেন্ট্রাল কমান্ড ও কন্ট্রোল ইউনিটে। ওই ভবনে থেকে রাজধানীর কয়েকশো পয়েন্টের ক্লোজসার্কিট ক্যামেরা পর্যবেক্ষণ করে পুলিশের মাঠের সদস্যদের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের আদেশ দেয়া হয় সেখান থেকেই।
সেদিন ওখানে উপস্থিত থাকা কয়েকজন পুলিশ সদস্য টিবিএসকে বলেছেন, সকাল থেকেই বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন ডিআইজি হারুন অর রশীদ। ঘণ্টায় ঘণ্টায় তিনি মাঠের পুলিশদের সাথে যোগাযোগ রাখছিলেন, এবং মাঠের কর্মকর্তাদের বলছিলেন, সোমবারই হবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের শেষ দিন, এরপর দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
এমনকি ঢাকার উত্তর পয়েন্টে ব্যারিকেড ভেঙ্গে যখন হাজারো জনতা শহীদ মিনারের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাচ্ছিল– তখনও তাদের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের আদেশ দেয়া হয়। ডিআইজি হারুন উত্তরার উপ-পুলিশ কমিশনারকে ফোন করে উত্তেজিত ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে বলেন বারবার। তবে ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার জানান, ‘স্যার অন্তত ২৫ হাজার মানুষ। এত মানুষকে অল্পসংখ্যক পুলিশের পক্ষে গুলি ছুঁড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়।’ এরপরও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ও হারুন অর রশীদ পুলিশকে বলপ্রয়োগে বাধ্য করেন। পরে ছাত্রজনতা খিলক্ষেত পেরিয়ে বনানীর দিকে এগিয়ে গেলে– সেখানে ব্যরিকেড দিয়ে এপিসি কার থেকে পজিশন নিয়ে গুলি করার কথাও বলা হয়। তবে তাতে সায় দেননি বনানী ও গুলশানে দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা। দুপুর সোয়া দুইটা নাগাদ জনতার ঢল জাহাঙ্গীর গেট থেকে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় অভিমুখে এগিয়ে গেলে– ওইরকম পরিস্থিতিতেও গুলির নির্দেশ আসে। তবে সেখানকার দায়িত্বরত সদস্যরা জানান ‘স্যার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে, আমাদের কিছুই করার নাই।’