* অভিযান অব্যাহত, লুট হওয়া ৫৩৪ অস্ত্র উদ্ধার
* অনুপস্থিত অনেকে অসুস্থ
* স্বাভাবিক হচ্ছে সারাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি
* সতর্ক অবস্থানে পুলিশ, ভয়ের কিছু নেই
* নির্ধারণ হচ্ছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ
* নাগরিক নিরাপত্তা কমিটি গঠনের নির্দেশনা
রাজধানীসহ সারাদেশে প্রায় শতভাগ পুলিশ সদস্যই নিজ নিজ থানায় যোগদান করেছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে কর্মবিরতি পালন করা পুলিশ সদস্যদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। এরপর থেকেই কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করে থানা-পুলিশ। তবে বেঁধে দেওয়া সময় শেষ হলেও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমপক্ষে ২৫ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাদের কর্মস্থলে যোগ দেননি বলে জানা গেছে।
এর আগে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উত্তাল পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানীসহ সারাদেশের থানা, পুলিশ ফাঁড়ি ও অন্যান্য পুলিশি স্থাপনায় ব্যাপক হামলার ঘটনা ঘটে। পুলিশের ওপর আক্রমণ ও অস্ত্রসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র লুট করা হয়। এসব হামলায় থানাগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। বিশেষ করে ৫ আগস্ট পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। এই দিনে থানা থেকে পুলিশ সদস্যরা গা-ঢাকা দেন এবং অধস্তন পুলিশ সদস্যরা কর্মবিরতির ঘোষণা দেন। ফলে সারাদেশের সব থানার পুলিশি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। উদ্ভূত পরিস্থিতির মধ্যে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ধীরে ধীরে থানা-পুলিশের কার্যক্রম পুনরায় চালু করা হয়েছে। বর্তমানে লুট হওয়া অস্ত্র ও বিভিন্ন নথি উদ্ধার কার্যক্রম চলছে।
এমন অবস্থার মধ্যে গত ১১ আগস্ট স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. এম সাখাওয়াত হোসেন পুলিশ সদস্যদের ১৫ আগস্টের মধ্যে কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার সময় বেঁধে দেন। তিনি বলেন, ‘বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে কাজে যোগ না দিলে অনুপস্থিতরা আর চাকরি করতে চাইছেন না বলে ধরে নেয়া হবে।’ তার এই ঘোষণার পর থেকেই পুলিশ সদস্যরা কাজে যোগ দেওয়া শুরু করেন।
ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) হারুন অর রশীদ, যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারসহ অন্তত ১০ শতাংশ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কাজে যোগ দেননি। এর মধ্যে অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার থেকে শুরু করে অতিরিক্ত আইজিপি পদমর্যাদার ঊর্ধ্বতন পুলিশ সদস্যরাও রয়েছেন। তবে উপপরিদর্শক ও পরিদর্শক পদমর্যাদার প্রায় শতভাগ পুলিশ সদস্য কাজে যোগ দিয়েছেন। তবে অনুপস্থিত অনেকের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ অবস্থায় আছেন। তবে শেষ সময়ে যে ২৫ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কর্মস্থলে আসেননি, তাদের নাম-পরিচয় জানাতে অপারগতা প্রকাশ করে ডিএমপি।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের জনসংযোগ কর্মকর্তা (পিআরও) কামরুল আহসান দাবি করেন, বেঁধে দেওয়া সময়ের আগেই নিচের দিকের প্রায় সব সদস্য কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন।
নতুন করে যারা কাজে দিয়েছেন, তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নানা কারণে তাদের মধ্যে ভয় চেপে বসেছিল। চাকরি হারানোর ভয় যেমন ছিল, নিরাপত্তার ভয়ও তেমনি ছিল। এরপর তারা কর্মস্থলে যোগ দিলেও পূর্ণাঙ্গভাবে সেবা দেওয়া শুরু করতে পারেননি। অনেক থানায় এখনো কোনো যানবাহন নেই, অস্ত্র, গোলা-বারুদ নেই। এছাড়াও অনেক থানা, ফাঁড়ি কিংবা পুলিশ বক্সে এখনো কর্ম পরিবেশ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।
এদিকে, বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যেও যারা কাজে যোগ দেননি, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে সে ব্যাপারে কিছু জানা যায়নি। বিষয়টি নিয়ে অনেক কর্মকর্তা কথা বলতে আগ্রহ প্রকাশ করছেন না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার, মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা আসেনি।
পুলিশ সদর দফতরও জানিয়েছে, দেশে মোট ৬৩৯টি থানার মধ্যে সব ক’টিতে পুরোদমে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর মধ্যে মহানগরের (মেট্রোপলিটন) আওতাধীন ১১০টি থানার এবং জেলা পর্যায়ের ৫২৯টি থানার কার্যক্রম পুনরায় চালু হয়েছে। এছাড়া রেলওয়ে পুলিশের ২৪টি থানায়ও পুরোদমে কার্যক্রম চলছে।
অন্যদিকে, সারাদেশে লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৫৩৪টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া উদ্ধার করা হয়েছে ১০ হাজার ২১৯ রাউন্ড গুলি, ৩৫৯টি টিয়ার গ্যাস ও ১৪২টি সাউন্ড গ্রেনেড। এই উদ্ধারকৃত অস্ত্র ও গোলাবারুদ পুলিশের হাতে ফিরে আসার ফলে নিরাপত্তা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হচ্ছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, ঢাকা মহানগরীর থানাগুলোতে কার্যক্রম শুরু হয় ৯ আগস্ট থেকে। এর মধ্যে প্রথমে কার্যক্রম শুরু করে রমনা, কলাবাগান, ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, কোতোয়ালি, চকবাজার, সূত্রাপুর, ডেমরা, গেন্ডারিয়া, মতিঝিল, সবুজবাগ, শাহজাহানপুর, শেরেবাংলা নগর, হাতিরঝিল, শাহ আলী, কাফরুল, ভাষানটেক, দারুসসালাম, রূপনগর, ক্যান্টনমেন্ট, বনানী, উত্তরা পশ্চিম, উত্তরখান ও বিমানবন্দর থানা। প্রথমে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এসব থানার কার্যক্রম শুরু পাশাপাশি চলে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার অভিযান।
চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলার থানাগুলোর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক। প্রাথমিকভাবে থানা ও পুলিশ ফাঁড়ির অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে ২১ কোটি টাকা। বিশেষ করে পাহাড়তলী থানায় ১ কোটি ৬০ লাখ, ইপিজেড থানায় ৭০ লাখ, পতেঙ্গায় ৮০ লাখ, হালিশহরে দেড় কোটি, ডবলমুরিংয়ে ১ কোটি ২০ লাখ, চান্দগাঁওয়ে ১ কোটি ২০ লাখ, বন্দর থানায় দেড় কোটি, সদরঘাটে ৮০ লাখ এবং আকবর শাহ থানায় ৭০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (সদর) এস এম মোস্তাইন।
তিনি বলেন, লুট হওয়া অস্ত্রগুলো উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত আছে। আমরা ফাঁড়ির আসবাবসহ অন্যান্য জিনিসের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের কাজ করছি। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত থানাগুলোর মেরামতের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে বিকল্প ব্যবস্থায় সব থানার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তিনি আরো বলেন, পুলিশ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
বরিশাল সেনাবাহিনীর সাত পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) মেজর জেনারেল আব্দুল কাইয়ুম মোল্লা জানিয়েছেন, বরিশাল বিভাগে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে একটি গুলিও ফায়ার করতে হয়নি। আমাদের বরিশাল বিভাগে ৫০টি থানা রয়েছে, যার একটিতেও আক্রমণ হয়নি। আমাদের পুলিশ ভাইয়েরা অক্ষত ছিল, একটি অস্ত্রও হারায়নি।
বরিশাল নগর গোয়েন্দা শাখার ইন্সপেক্টর ছগির হোসেন জানান, গোয়েন্দা পুলিশের সকল টিম জণগণের সেবায় নিয়জিত আছে। আমাদের কার্যক্রম নিয়মিতভাবে চলছে।
বর্তমানে থানার কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশ কমিশনার জিহাদুল কবির জানান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের ওপর হামলার কারণে বরিশাল মেট্রোতে মোট ছয়দিন পুলিশি কার্যক্রম বন্ধ ছিল। তবে এখন সকল কার্যক্রম সক্রিয়ভাবে চলছে, বেড়েছে কাজের গতি।
রংপুরের এডিশনাল এসপি (ডিএসবি) ইফতেখার আলম জানান, আমাদের সবগুলো থানার কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছে। তবে সেবা প্রত্যাশীর সংখ্যা কিছুটা কম। কেউ সেবা নিতে আসলে আমরা তাদের সহযোগিতা করছি।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের বিভিন্ন থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্রগুলোর মধ্যে ৭৭টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র এবং ১২৬ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর সহায়তায় ৬০টি অস্ত্র এবং পুলিশ কর্তৃক ১৭টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার হওয়া অস্ত্রগুলোর মধ্যে এসএমজি, চায়না রাইফেল, পিস্তল , শর্টগান এবং গ্যাস গান রয়েছে।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অফিসার অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম ডেইলি বাংলাদেশকে জানান, কী পরিমাণ অস্ত্র এবং গুলি লুট হয়েছে তার প্রকৃত হিসাব এখনই বলা যাচ্ছে না। আমরা প্রকৃত হিসাব মেলানোর কাজ করছি। আমাদের সব থানার কার্যক্রম এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। সেবাগ্রহীতারা আসছেন। আমার তাদের পূর্ণসেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।
ময়মনসিংহ রেঞ্জের ডিআইজি শাহ আবিদ হোসেন জানান, আমাদের সবগুলো থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আমরা গ্রাহকদের সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমাদের দুটি থানায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সেই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি।
রাজশাহী জেলা পুলিশ সুপার সাইফুর রহমান জানিয়েছেন, এরই মধ্যে মধ্যে বেশির ভাগ থানায় কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কিছু জায়গায় অবকাঠামোগত সমস্যা রয়েছে। ২-১ দিনের মধ্যেই স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হবে।
এদিকে, আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার ও জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর জন্য নাগরিক নিরাপত্তা কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই কমিটি স্থানীয় সংঘাত নিরসন, মাদক, ইভটিজিং এবং অন্যান্য সমস্যার সমাধানে কার্যক্রম গ্রহণ করবে। কমিটির সদস্য হিসেবে আইনজীবী, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা, সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা, সিনিয়র সিটিজেন, রাজনৈতিক নেতা, মানবাধিকার কর্মী, নারী অধিকার কর্মী এবং এনজিও প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত থাকবেন।
বাংলাদেশ পুলিশের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর ডেইলি বাংলাদেশকে জানিয়েছেন, দেশের ৬৩৯টি থানার সব ক’টিতে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। মেট্রোপলিটন থানাগুলোর ১১০টি এবং জেলা পর্যায়ের ৫২৯টি থানার কার্যক্রম পুনরায় চালু হয়েছে। রেলওয়ে পুলিশের ২৪টি থানাতেও কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
তিনি বলেন, সারাদেশের সব থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আমরা নিয়মিত অপারেশনাল কার্যক্রমও শুরু করেছি। রেলওয়ে থানাগুলোও তাদের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে শুরু করেছে।