ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র-কাউন্সিলররা লাপাত্তা



শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর সারাদেশে সরকারি বেসরকারি স্থাপনা, বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে যে বেপরোয়া হামলা হয়েছে, তা থেকে বাইরে নয় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর কার্যালয়ও। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র-কাউন্সিলররা লাপাত্তা।


এদিকে সরকার পতনের পর দুই মেয়র প্রকাশ্যে নেই। ঢাকা উত্তরের মেয়র এম আতিকুল ইসলাম নিশ্চিত করেছেন, তিনি ঢাকায় আছেন। তবে অফিস করছেন না। আর ঢাকা দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের অবস্থান সম্পর্কে কারও কিছু জানা নেই। যেসব কাজে মেয়রের সই লাগে, সেগুলো নিয়ে কীভাবে কী করা যায়, তা নিয়ে ভাবছেন কর্মকর্তারা। অন্যদিকে কাউন্সিলরের কার্যালয়ে প্রতিদিনই মানুষ আসছে, সেবা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে।


ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র জামাল মোস্তফার হদিস নেই ৫ আগস্ট থেকেই। তিনি কবে ফিরবেন বা কোথায় আছেন, সেই প্রশ্নেরও জবাব নেই।


ঢাকা উত্তরের ৫৪ জন সাধারণ ও ১৮ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরের মধ্যে দুজন করে কেবল চারজন বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত। বাকি সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত।


দক্ষিণের ৭৫ জন সাধারণ ও ২৫ জন নারী আসনের কাউন্সিলরের মধ্যে ১০ জন বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত, একজন স্বতন্ত্র ও একজন বিজেপির রাজনীতিতে জড়িত।


এই পরিস্থিতিতে সিটি করপোরেশনের নাগরিক সেবায় বিঘ্ন ঘটছে; বিশেষ করে ঢাকা উত্তরে ওয়ারিশ সনদ, জন্মনিবন্ধন সনদ, মৃত্যু নিবন্ধন সনদ, নাগরিক প্রত্যয়নসহ কাউন্সিলর অফিস থেকে নিতে হয় তার কিছুই পাচ্ছে না মানুষ।


ঢাকা দক্ষিণে অবশ্য জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন সনদ নিয়ে সমস্যা নেই, কারণ এগুলো দেয়া হয় আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে, সেগুলো চালু আছে।


ঢাকার তেজগাঁওয়ের কলোনিবাজারে ঢাকা উত্তরের (ডিএনসিসি) ৫ আগস্ট ২৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, প্রধান কার্যালয়ের ফটকে তালা ঝুলছে। দোতলা ভবনের নিচতলায় ওয়ার্ড সচিবের রুম জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। পুড়ে গেছে সব কাগজপত্র। সেখান থেকে লুট করা হয়েছে কম্পিউটারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র। নাজমুল নামে একজন কর্মী বলেন, প্রতিদিনই লোকজন বিভিন্ন কাজে আসে।


পল্লবীতে ডিএনসিসির ৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ও ভাঙচুর করা হয়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, কম্পিউটার, ল্যাপটপ এবং জন্মনিবন্ধনসহ গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রও লুট করা হয়। ওই ওয়ার্ডের সচিব মো. আবদুস সামাদ বলেন, সব নিয়ে গেছে। আমরা আঞ্চলিক কার্যালয়ে লিখিতভাবে জানিয়েছি, স্যাররা বলেছেন আপাতত কার্যক্রম অফ রাখতে। আর এখানে কাজ করার মত কিছুই নাই। প্রতিদিন অন্তত ৫০ জন মানুষ এসে ঘুরে যায়।


বাড্ডায় ডিএনসিসির ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অফিসও ভাঙচুর করা হয় ৫ অগাস্ট। ওই ওয়ার্ডের সচিব নেসার আহমেদ রাসেল বলেন, সেদিন হামলা করে অফিসের সবকিছু নিয়ে গেছে। নেয়া হয়েছে টিসিবির চালও। চারপাশের দেয়াল ছাড়া অফিসে আর কিছু নেই। অনেকের জন্মনিবন্ধনসহ কিছু সার্টিফিকেট রেডি করা ছিল সেগুলো, আড়াই টন চালের ডিও ছিল গরিব মানুষের জন্য, সেই ডিও নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। কাউন্সিলর নাই, পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আমাকে অনেকে ফোন দেয় বিভিন্ন সেবার জন্য। কিন্তু এ অবস্থায় সেবা দেয়া সম্ভব না।


ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, আঞ্চলিক কার্যালয়ে আগুন দেয়া হয়েছিল, ভাঙচুর করা হয়েছে। ব্যবহার করা যাবে না এমন পরিস্থিতি হয়নি। সেখানে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। নতুন সরকার মাত্র দায়িত্ব নিল। সরকার হয়তো এসব বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত নেবে। কাউন্সিলরদের কেউ চলে যেতে বলেনি, আবার এই অবস্থায় তাদের আসতে বলবে সেটাও কেমন দেখায়। তারা নির্বাচিত পরিষদ, কোনো সাইকোলজিক্যাল থ্রেটের কারণে যদি অনুপস্থিত থাকেন, সেটা ভিন্ন কথা।


ঢাকা উত্তরের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম সোমবার গণমাধ্যমকে বলেন, তিনি ঢাকাতেই আছেন, তবে আপাতত অফিসে যাচ্ছেন না। টেলিফোনে কর্মকর্তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন। টেলিফোনে বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজের নিদের্শনা দিচ্ছি। যেসব কাজ আমার হাতে আছে সেগুলো আমি করছি, আমিও চাই সবকিছু স্বাভাবিক হোক। কাউন্সিলররাও তাদের কাজগুলো করুক, জনগণ যেন সেবা বঞ্চিত না হয়।


সরকার পতনের দাবিতে ডাকা অসহযোগের ডাক দেয়ার পর তার ঢাকা দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের বিমানে চড়ার একটি ছবি ভাইরাল হয়। সেদিনই তিনি দেশ ছেড়েছেন কিনা, সেটি নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। মেয়র প্রকাশ্যে নেই, এই অবস্থায় যেসব ফাইলে তার সই দরকার, সেগুলো কীভাবে হবে- এই প্রশ্নে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান বলেন, তিনি (মেয়র) কখন আসবেন সে বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। আমাদের কার্যক্রম শুরু হয়েছে, মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মহোদয় যোগ দিয়েছেন। আমাদের সচিব মহোদয় আছেন, উনারদের সঙ্গে পরামর্শ করে অবশ্যই আমরা কাজগুলো করে নেব। কোনো সমস্যা হবে বলে মনে করি না।


অন্য এক প্রশ্নে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে সিটি করপোরেশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি কাজ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং মশক নিধন কার্যক্রম পুরোদমে চলছে। কাউন্সিলদের যেসব কাজ আছে সেগুলো তারা আগের নির্ধারিত জায়গায় করতে পারছেন না। তবে যোগাযোগের মাধ্যমে তারা অন্য জায়গা থেকে সেসব সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তারপরও আমাদের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় আছে। নাগরিকরা তাদের সেবার জন্য সেখানে আসতে পারেন।